বাড়তি মূল্যে বিক্রি এলপিজি, নেই তদারকি

দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দাম সমন্বয় করেছে সরকার। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দাম কেউ মানছেন না। খুচরাপর্যায়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম গ্রাহকপর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯০৬ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ের খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। যাদের সংযোগ আছে তারাও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছেন না। দৈনন্দিন রান্নায় সাধারণ মানুষ লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি’র ওপর নির্ভর করছেন। এ সুযোগে গ্রাহকের কাছ থেকে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ইচ্ছা মতো আদায় করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো।

গত ২৯ এপ্রিল দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সমন্বয় করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজি মূসকসহ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০৬ টাকা। যা আগে ছিল ৯৭৫ টাকা। গত ১ মে থেকে নতুন এ দাম কার্যকর হয়েছে— বলছে বিইআরসি। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দামে কেউ এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করছেন না।

গত ২৯ এপ্রিল দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সমন্বয় করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজি মূসকসহ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০৬ টাকা। যা আগে ছিল ৯৭৫ টাকা। গত ১ মে থেকে নতুন এ দাম কার্যকর হয়েছে— বলছে বিইআরসি। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দামে কেউ এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করছেন না

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বেশি দামেই তাদের এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে। কোম্পানি ও ডিলাররা দাম না কমালে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, এলপিজি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিইআরসি বাজার বিবেচনা করে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেনি। তাই ডিলার ও দোকানিরা তা মানছেন না।
বিইআরসি বাজার বিবেচনা করে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেনি, বলছেন ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা

বসুন্ধরা এলপিজি’র মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. জাকারিয়া জালাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রির জন্য আমরা এলপিজি সরবরাহ করছি। খুচরাপর্যায়ে ৯০৬ টাকায় বিক্রির কথা। তবে কিছু ক্ষেত্রে দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। এর কারণ হলো, খুচরা বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এলপিজি পৌঁছে দিচ্ছেন। তখন তারা সার্ভিস চার্জ হিসাবে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি নিচ্ছেন।’
সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে মাঠপর্যায়ে সে দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ, বেশি দামে কিনতে হয়। এখন সরকার যদি অভিযানে নামে তাহলে বুঝতে পারবে আসল তথ্য কী
মো. এমরান, এলপিজি’র খুচরা বিক্রেতা

বেক্সিমকো এলপিজি গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার মো. মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেক্সিমকোর এলপিজি ডিলারপর্যায়ে ৮৫৫ টাকা বিক্রি হয়। এর সঙ্গে ২৪ টাকা যোগ করে ডিলাররা ৮৭৯ টাকা দরে বিক্রি করেন খুচরাপর্যায়ে। খুচরা বিক্রেতারা ২৭ টাকা লাভে ৯০৬ টাকায় বিক্রি করেন। তবে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতারা ৭৫ টাকা পর্যন্ত চার্জ নিয়ে থাকেন।

‘সার্ভিস চার্জের বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনা নেই। আমাদের কাস্টমার সার্ভিসে কল দিলে তারা ৯০৬ টাকার সঙ্গে ৭৫ টাকা সার্ভিস চার্জ নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেন। দাম এর বেশি হওয়ার কথা নয়’— বলেন মেহেদী হাসান।

তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিযোগ, খুচরা বিক্রি করতে সরকার ৯০৬ টাকা দাম নির্ধারণ করেছে। অথচ ডিলারদের কাছ থেকে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে হয় ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকায়। তাহলে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে আমরা কীভাবে বিক্রি করব?
সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রির জন্য আমরা এলপিজি সরবরাহ করছি। খুচরাপর্যায়ে ৯০৬ টাকায় বিক্রির কথা। তবে কিছু ক্ষেত্রে দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। এর কারণ হলো, খুচরা বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এলপিজি পৌঁছে দিচ্ছেন। তখন তারা সার্ভিস চার্জ হিসাবে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি নিচ্ছেন
মো. জাকারিয়া জালাল, মহাব্যবস্থাপক (বিপণন), বসুন্ধরা এলপিজি

এলপিজি’র খুচরা বিক্রেতা মো. এমরান বলেন, মিডিয়ায় যে দামের কথা শুনি আর অনলাইন যে রেট দেওয়া আছে, বাস্তবচিত্র কিন্তু ভিন্ন। ৯৫০ টাকার নিচে আমরা কিনতে পারি না। খরচসহ আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে এক হাজার টাকা পড়ে যায়। তাহলে কীভাবে ৯০৬ টাকায় বিক্রি করব? খরচ ও লাভ যোগ করে ১০৫০ টাকায় বিক্রি করি।

তিনি আরও বলেন, সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে মাঠপর্যায়ে সে দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ, বেশি দামে কিনতে হয়। এখন সরকার যদি অভিযানে নামে তাহলে বুঝতে পারবে আসল তথ্য কী? ডিলারদের কাছ থেকে আমরা যদি কম দামে কিনতে পারি তাহলে ভোক্তাপর্যায়ে কম দামে বিক্রি করতে পারব।

রাজধানীর মুগদা-মান্ডার বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের ডিলার সুজন জানান, পাইকারিপর্যায়ে ৯০৫ থেকে ৯১০ টাকা আর খুচরাপর্যায়ে ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি করছি। কেনা ও খরচ হিসাব করলে সরকার নির্ধারিত ৯০৬ টাকা দামে বিক্রি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে, কোম্পানি থেকে কত টাকা দিয়ে কিনছেন, তা জানাতে রাজি হননি এ ডিলার।
সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই দাম নির্ধারণ হয়েছে। দাম যৌক্তিক হয়নি— এমনটি বলে তারা বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন না
মো. আব্দুল জলিল, চেয়ারম্যান, বিইআরসি

এলপি গ্যাস ব্যবহারকারী বাবুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি— এমন খবর কেবল মিডিয়াগুলোতে শুনি। বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। আমরা তো আগের দামে কিনছি। আজও ১২ কেজির সিলিন্ডার ১১০০ টাকা নিল। তাহলে দাম কম হলো কই? সরকারি দামের চেয়ে ২০০ টাকা বেশি!

এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তা ও ডিলাররা জানান, সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ডিলাররা ব্যবসা করতে চাচ্ছেন না। একজন ডিলারকে দুবার মাল উঠাতে ও নামাতে হয়। এখানে একটা খরচ আছে। এরপর তার গোডাউন ও দোকান ভাড়া রয়েছে। সবমিলিয়ে খরচ হয় প্রায় ৬০ টাকা। সেখানে সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করলে ডিলারদের থাকে মাত্র ২৪ টাকা। বাকি টাকা তো তার পকেট থেকেই গুনতে হবে।

এছাড়া একজন খুচরা বিক্রেতার সারাদিনে এলপি গ্যাস বিক্রি হয় চার থেকে পাঁচটি। এক হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সিলিন্ডারপ্রতি মাত্র ২৭ টাকা লাভ তাদের পোষায় না। দোকান ভাড়ার খরচও এতে ওঠে না। এসব কারণে খুচরাপর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
লকডাউনের কারণে মাঠপর্যায়ে সরাসরি পদক্ষেপ দিতে সমস্যা হচ্ছে। তবে যেসব অভিযোগ আসছে আমরা আমলে নিচ্ছি। অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে
মো. আব্দুল জলিল, চেয়ারম্যান, বিইআরসি

এসব বিষয়ে এলপিজি কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হবে— এমনটি জানিয়েছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, আজ-কালের মধ্যে তারা সরকারকে একটা প্রস্তাব দেবেন। তারা আশা করছেন, সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে দাম পুনর্নির্ধারণ করবে সরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার ১০৫০ টাকা হওয়া উচিত, মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ বেশিতে বিক্রি করতে পারেন না। যদি কেউ বিক্রি করেন তা আইনগত অপরাধ। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব। ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিদফতর এ বিষয়ে বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করেছে।

‘লকডাউনের কারণে মাঠপর্যায়ে সরাসরি পদক্ষেপ দিতে সমস্যা হচ্ছে। তবে যেসব অভিযোগ আসছে আমরা আমলে নিচ্ছি। অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠকে আমরা তাদের বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি।’
ভোক্তা সাধারণের কাছে অনুরোধ, যদি কেউ বেশি দামে এলপিজি বিক্রি করেন, আপনারা আমাদের হটলাইন- ১৬১২১ নম্বরে অভিযোগ করুন। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব
মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার, উপপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর

দাম যৌক্তিক হয়নি— কোম্পানিগুলোর এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই দাম নির্ধারণ হয়েছে। দাম যৌক্তিক হয়নি— এমনটি বলে তারা বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন না।’

এলপিজি বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, বিষয়টি তদারকি হচ্ছে কি না— জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক (উপসচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিয়মিত বাজার তদারকিকালে সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে কি না, তা দেখা হচ্ছে। যারা বেশি দামে বিক্রি করছেন তাদের আইনের আওতায় এনে জরিমানা করছি।’

‘ভোক্তা সাধারণের কাছে অনুরোধ, যদি কেউ বেশি দামে এলপিজি বিক্রি করেন, আপনারা আমাদের হটলাইন- ১৬১২১ নম্বরে অভিযোগ করুন। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব’— বলেন মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।